শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় পদ্মার ভাঙনকবলিত এলাকা এখন বিনোদনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। নদীর দৃষ্টিনন্দন তীর রক্ষা বাঁধ ও ওয়াকওয়েতে হাজারো মানুষ বেড়াতে যাচ্ছেন। নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ এলাকায় জয় বাংলা অ্যাভিনিউতে গতকাল শনিবার ঈদের দিন বিকেলে দুই কিলোমিটারব্যাপী এলাকায় মানুষের ঢল নামে। পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন আশপাশের মানুষ।
সরেজমিন দেখা যায়, নদীর তীরে ঘুরতে আসা মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। কেউ নদীতে মাছ শিকারের দৃশ্য দেখে, কেউ পদ্মায় সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে বিমোহিত হচ্ছেন। স্মৃতি ধরে রাখছেন মুঠোফোনের ক্যামেরায়। বাঁধের পাশে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁ ও ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে মুখরোচক নানান খাবারের স্বাদ নিয়েছেন অনেকে। অনেকে পদ্মা নদীতে নেমে সাঁতারও কাটছেন। নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ, কেদারপুর, সাধুরবাজার, চণ্ডীপুর, পাঁচগাঁও ও সুরেশ্বর এলাকায় অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।
নড়িয়া উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নড়িয়ার পদ্মার তীরবর্তী তিনটি ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভার কিছু এলাকায় প্রবল নদীভাঙন ছিল। ওই সময়ে ভাঙনে অন্তত ২০ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়। তিনটি বাজারের অন্তত ৫ শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পদ্মায় বিলীন হয়। সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাও হারিয়ে যায় নদীগর্ভে। নড়িয়ার ভাঙন ঠেকাতে ২০১৯ সালে ‘নড়িয়া-জাজিরা পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলে প্রথমে ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এরপর পাথর ও সিমেন্টের তৈরি ব্লক ফেলে ও ব্লক বসিয়ে নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ কিলোমিটার নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ১১ কিলোমিটার নদীর চর খননকাজ চলছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের উদ্যোগে ওই বাঁধ ঘেঁষে চার কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। নড়িয়ার মুলফৎগঞ্জ বাজার থেকে সুরেশ্বর লঞ্চঘাট পর্যন্ত ওই ওয়াকওয়ের নামকরণ করা হয় জয় বাংলা অ্যাভিনিউ। ওয়াকওয়ের পাশ দিয়ে ঝাউগাছসহ বিভিন্ন গাছ লাগানো হয়েছে। দর্শনার্থীদের বসার জন্য বিভিন্ন স্থানে বেঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। নদীতে নামার জন্য প্রতি ৩০০ মিটার অন্তর সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। জয় বাংলা অ্যাভিনিউ দৃষ্টিনন্দন করার জন্য টাইলস ও লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে।
মাদারীপুর সদরের মোস্তফাপুর থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে নড়িয়ার পদ্মার তীরে এসেছেন মহিউদ্দিন খান। তিনি জাজিরা সময় কে বলেন, ‘নড়িয়ার পদ্মাতীরের বাঁধের সৌন্দর্যের কথা শুনেছি। ঈদের দিন পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসে ভালো লেগেছে। ছোট ছোট নৌকায় মাছ শিকার করতে দেখে বাচ্চারা আনন্দ পেয়েছে। পদ্মা নদীতে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে বিমোহিত হয়েছি।’
শরীয়তপুরের গোসাইরহাট থেকে সিহাব উদ্দিন-তামান্না আক্তার দম্পতি এসেছিলেন নড়িয়ার পদ্মার তীরে। তাঁরা জানান, বিয়ের দুই মাস হলেও কোথায়ও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। নড়িয়ার পদ্মার তীরে এসে তাঁরা মুগ্ধ হয়েছেন। সমুদ্রসৈকতের আদলে সাজানো হয়েছে বলে তাঁরা আনন্দিত হয়েছে।
নড়িয়ার কেদারপুরের বাসিন্দা মিথিলা আক্তার। ২০১৮ সালে ভাঙনে তাঁদের দোকান ও বাড়ি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। বাড়ির অবশিষ্ট জমিতে বাঁধের পাশে এখন রেস্তোরাঁ খুলে ব্যবসা করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নদীর তীর রক্ষা বাঁধের কারণে এখন জনপদটির চিত্র বদলাচ্ছে। এখানে বিভিন্ন স্থানের পর্যটক আসছেন। তাঁর অনেকেই ব্যবসা খুলে বসেছেন। নদীভাঙনে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বাঁধটি তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি করেছে।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শংকর চন্দ্র বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, নড়িয়ার পদ্মাতীরে মানুষ বেড়াতে আসছেন। ঈদের কারণে পর্যটকের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। সেখানে যাতে মানুষ নিরাপদ ও স্বস্তি বোধ করেন, এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক পুলিশ রাখা হয়েছে।
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম প্রথম আলোকে বলেন, নড়িয়ার পদ্মার তীরবর্তী এলাকায় এলে মানুষের কান্না আর অসহায়ত্বের কথা শুনতে হতো। বাঁধ নির্মাণের কারণে এখন সেই নড়িয়ায় আনন্দ উৎসব হয়। পর্যটকেরা আসেন, উদ্যোক্তারা ব্যবসা করছেন। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নড়িয়ায় পাউবোর একটি রেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যটনকেন্দ্র করতে আরও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।