শরীয়তপুরে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশ

লেখক:
প্রকাশ: জুন ১১, ২০২৩

শরীয়তপুরের নড়িয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও সদ্য বদলি হওয়া পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে জেলা পুলিশ সুপারকে (এসপি) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

জাজিরার পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানার একটি ছিনতাই মামলার আসামিদের মারধর করে আহত করার ঘটনায় শরীয়তপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল ইমরান ৭ জুন এই আদেশে সই করেন।

রোববার (১১ জুন) আদালত পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে ওই আদেশের কপি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। ৯ জুলাইয়ের মধ্যে ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন, ২০১৩ -এর ৫ ধারা অনুযায়ী ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

শরীয়তপুরের আদালত পরিদর্শক মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ এ তথ্য নিশ্চিত করে মুঠোফোনে বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করার অভিযোগে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে আমলি আদালত থেকে একটি আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদেশে বলা হয়েছে জেলা পুলিশ সুপার এ বিষয়ে তদন্ত করে ৯ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করবে।

ভুক্তভোগীরা ও তাদের বড় ভাই আবু জাফর ঠান্ডু জেলা পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত ও মৌখিক  অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রইম অ্যান্ড অপস) মোহাম্মদ বদিউজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২৩ মে দ্রুত বিচার আইনে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় একটি ছিনতাই মামলা হয়। মামলায় শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা আহম্মেদ চোকদার কান্দি এলাকার সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। সেই মামলায় ২৯ মে সাদ্দাম, বকুল, সাইদুল উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হন। জামিনে আসার পর ৩০ মে রাতে তারা এ মামলার আরেক আসামি আনোয়ারকে নিয়ে ঢাকা কেরানীগঞ্জ সাদ্দামের বন্ধু আলমগীর চোকদারের বাসায় যান। ওইদিন রাতে তথ্য পেয়ে সেই বাসায় হাজির হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির ও ওসি মোস্তাফিজুর রহমান, জাজিরা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল বেপারীসহ ১০/১২ পুলিশ সদস্য।

অভিযোগে বলা হয়, এ সময় সাদ্দাম তাদের জামিনের কাগজ দেখালে তা ছিঁড়ে ফেলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। পরে পুলিশ সাদ্দাম ও বকুলকে লাথি, কিল-ঘুষি, চড়থাপ্পড়সহ পুলিশের লাঠি (ডান্ডা), কাঠ, হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। একপর্যায়ে প্লাস দিয়ে হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়। সাদ্দাম পানি পান করতে চাইলে ছোট ভাই বকুলকে দাঁড় করিয়ে মুখে প্রস্রাব করতে বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল মনির। পরে সাদ্দামের শরীরে প্রস্রাব করেন বকুল। এমন নির্যাতন চলে রাত ১টা থেকে পরদিন ৩১ মে সকাল ৮টা পর্যন্ত।

জানা যায়, কিছুক্ষণ পর ওই চারজনকে গামছা ও কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর নিচে আনা হয়। পরে সাদ্দাম ও বকুল এবং সাইদুল ও আনোয়ারকে আলাদা দুই স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি সাদ্দাম-বকুলকে বলেন, সাইদুল-আনোয়ারকে ক্রসফায়ার দিয়ে দিয়েছি। তোরা ৭২ লাখ টাকা দিবি, তা না হলে তোদেরও ক্রসফায়ার দিয়ে দেওয়া হবে।

এভাবে সারাদিন রেখে রাতে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় এনে ৭২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে বেত ও কাঠ, কোদালের বাট, লাঠি দিয়ে আবার বেধড়ক মারা হয় সাদ্দাম ও বকুলকে। সারারাত চলে এ নির্যাতন। এরপর টাকার জন্য বকুলের স্ত্রী সানজিদা, দুই বছরের সন্তান, বাবা রশিদ চোকদার, মা রমেলা ও চাচাতো ভাই আবু জাফর ঠান্ডুকে থানায় এনে সারারাত আটকে রাখা হয় এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগে জানা যায়, পরে আত্মীয়-স্বজনরা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসির কাছে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭২ লাখ টাকা দিলে নির্যাতন থেকে মুক্তি মেলে সাদ্দাম ও বকুলের। এ দুদিন যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও তাদের খাবার ও ঔষধ দেয়নি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও ওসি।

অভিযোগকারীরা জানান, ১ জুন বিকালে সাদ্দাম ও বকুলসহ চারজনকে শরীয়তপুর আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পরে পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক রিমান্ড না মঞ্জুর করেন। ৬ জুন বিকালে সাদ্দাম ও বকুলসহ চারজনই আদালত থেকে জামিন পায়।

ছিনতাই মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ২১ মে দুপুরে পদ্মা সেতু জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা এলাকার এক্সপ্রেসওয়ের সোহাগ পরিবহন থেকে জাজিরা উপজেলার বাসিন্দা শাহীন আলম শেখ (২০) ও সেকেন্দার মাদবরকে (৫১) জোরপূর্বক নামিয়ে তাদের সঙ্গে থাকা বিদেশি ডলার, মোবাইলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছিনতাই করে নিয়ে যায় স্থানীয় সাদ্দাম চোকদার, বকুল চোকদারসহ ১০/১১ জন। ডলারসহ যার আনুমানিক মূল্য ২১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা ধরা হয়েছে। এ ঘটনায় ২৩ মে শাহীন আলম শেখ বাদী হয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় সাদ্দাম, বকুলসহ নয়জনের নাম নিয়ে অজ্ঞাত পাঁচ/ছয়জনকে আসামি করে একটি ছিনতাই মামলা করেন। তবে শাহীন আলম শেখ ও সাদ্দাম চোকদারের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবত ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শত্রুতা রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

আদালতের আদেশের বিষয়ে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল হক বলেন, এসব ঘটনা আমরা তদন্ত করছি। অভিযোগের বিষয় প্রমাণ হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর আদালত থেকে কোনো আদেশ বা নির্দেশনা আমার দপ্তরে পৌঁছায়নি।

About The Author