পদ্মানদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে কিছু প্রভাবশালী মহল। দিনে ড্রেজারগুলো পদ্মানদীর জাজিরা প্রান্তে ভেড়ানো থাকে, রাত হলেই শুরু হয় নদী থেকে বালু উত্তোলন। তবে এসব অবৈধ ড্রেজার বন্ধে জেলা প্রশাসন ও নৌ-পুলিশ প্রশাসনের প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বালু ব্যবসায়ীরা স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন যাবত অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। পদ্মাসেতুর অদূরে নিয়মিত অবৈধ ড্রেজারে বালু উত্তোলন করায় ব্যাপক নদীভাঙনের কবলে পড়েছে পাইনপাড়া, মাঝিকান্দি, মোল্লাকান্দি, ব্যাপারীকান্দি গ্রামের বিস্তীর্ণ জনপদ। এরই মধ্যে ভাঙনের কবলে বসতি হারিয়েছে এসব গ্রামের অন্তত ৩০টি পরিবার। জাজিরা উপজেলায় পদ্মানদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র। তারা প্রতিদিন ৭০-৮০টি ড্রেজার দিয়ে রাত ১০টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত বালু উত্তোলন করে। এতে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়ায় নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে বাড়িঘর ও ফসলী জমি। এসব বালু উত্তোলনকারীদের হাত থেকে বাদ পড়ছে না পদ্মাসেতুর আশপাশের এলাকাও।
গত ২৬ জুলাই পদ্মানদী সংলগ্ন পাইনপাড়া, মাঝিকান্দি এলাকার সাধারণ জনগণ শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে মানববন্ধন করে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারক লিপি দিয়েছে।
২৯ জুলাই বিকালে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ পদ্মানদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে করণীয় বিষয়ক মতবিনিময় সভা করেছেন জাজিরা উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে।
পাইনপাড়ার বাসিন্দা মজিবর ছৈয়াল বলেন, ‘পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলতাফ খান তার ভাই মনির খান, জেলা পরিষদের সদস্য নেছার উদ্দিন মাদবর, খবির ফরাজি, তুহিন ফরাজি, চুন্নু মাদবর, রাজ্জাক মাঝিসহ আরও কয়েকজন বালুদস্যু চক্ররের লোকজন দির্ঘদিন যাবৎ নৌপুলিশ ও প্রশাসনকে হাত করে পদ্মানদী থেকে বালু উত্তলন করছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা ইয়াকুব বেপারী বলেন, ‘আমরা অনেকবার মানববন্ধন করেছি, ডিসি অফিসে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। এই নাওডোবায় যারা প্রভাবশালী তারাই অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত। দিনের বেলা বালুবাহী খালি জাহাজ মাঝিরঘাটে পদ্মা নদীর দুই পাশে এনে রাখা হয়। রাতে এশার নামাজের পরে নদীর মধ্যে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
নুর মোহাম্মদ বেপারী বলেন, ‘আমরা প্রভাবশালীদের সাথে পারি না। তাদেরকে বারবার বলার পরেও তারা থামছে না। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই আমাদের শেষ ভরসা। তাঁর কাছে আকুল আবেদন, তিনি যেন এমন একটা পদক্ষেপ নেন, যাতে পদ্মানদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়।’
রাজ্জাক মাঝি বলেন, ‘এটা হলো লুকোচুরি খেলা, আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, রাতের বেলা ওখানে বালু তোলা হয়। আমার নামে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেটা মিথ্যা। তবে রাতের আঁধারে ওই জায়গায় বালু তোলা হয় এটা সত্য।’
পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলতাফ খান বলেন, ‘আমার একটা ড্রেজার আছে সত্য, কিন্তু আমি সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি আমার ছেলেরা ড্রেজার বন্ধ করতে গিয়ে মামলা খেয়েছি। এখন যদি কেউ আমাকে দোষারোপ করে তাহলে ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।’
জেলা পরিষদের সদস্য নেছার উদ্দিন মাদবর বলেন, ‘আমি ড্রেজারের সাথে জড়িত নই। ডিসি স্যার ওইদিন সবাইকে বলে দিয়েছে, যারা বালু উত্তোলন করবে তাদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা হবে।’
নৌপুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘পদ্মাসেতু এলাকায় ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের বিষয়ে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। দিনে অথবা রাতে কোনো অবস্থাতেই পদ্মানদীতে যেন ড্রেজার থাকতে না পারে আমরা সেই ব্যবস্থা করবো। পদ্মানদী থেকে বালু উত্তোলন করবে, এটা যেন কেউ চিন্তাও না করতে পারে। এখান থেকে আমি নিজেও উপস্থিত থেকে অভিযান পরিচালনা করবো।’
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ বলেন, ‘পদ্মা নদীর জাজিরা প্রান্তে দীর্ঘদিন যাবত একটি মহল বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। গত এক বছরে আমরা প্রায় ৩০টি অভিযান পরিচালনা করেছি। এতে ২৭ জনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো বালু উত্তোলন করা হয় মধ্যরাতে। তাছাড়া কখনো কখনো তারা আমাদের অভিযানের উপর হামলা করার চেষ্টা করেছে। সাধারণত দেখা যায়, আমরা যখন অভিযান পরিচালনা করে থাকি তার পরের দিন থেকেই আবার বালু উত্তোলন শুরু করে, যার কারণে আমরা জাজিরায় একটি মতবিনিময় সভা করেছি, যাতে স্থায়ীভাবে এই বালু উত্তোলন বন্ধ করা যায়। যেভাবে বালু উত্তোলন করছে তাতে আমাদের স্বপ্নের পদ্মাসেতুসহ পাইনপাড়া মাঝিরচরের প্রায় ১০ হাজার লোকের বসতি হুমকির মধ্যে পড়বে। এর পরবর্তী আঘাত আসবে জাজিরা উপজেলায়। সে কারণেই এর সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের আইডেন্টিফাই করার জন্য আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি, জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করব। পাশাপাশি আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।