কেন অস্ত্রভান্ডার বৃদ্ধিতে মনোযোগী এশিয়ার দেশগুলো

লেখক:
প্রকাশ: এপ্রিল ১৬, ২০২৩

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা পেছনে ফেলে তিনিয়ান দ্বীপ এখন নতুন আরেক অধ্যায় দেখতে শুরু করেছে। যে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র একসময় ছিল চিরশত্রু, তারাই এখন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনিয়ানে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সদস্যরা যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেন। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে এ দুই দেশের বিমানবাহিনীর এমন মহড়া আগে দেখা যায়নি। এ মহড়ায় প্রমাণ মেলে, দুই দেশ সামরিকভাবে কতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

জাপানের নাইনথ এয়ার উইং ফ্লাইট গ্রুপের কমান্ডার কর্নেল ইনাডোম সাতরু বলেন, ‘আমরা অতীত নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। আমাদের শঙ্কা ভবিষ্যৎ নিয়ে। সক্ষমতা প্রদর্শন করে আমরা স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনিয়ান দ্বীপ থেকেই জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলাকারী মার্কিন যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়েছিল। এখনো দ্বীপটিতে রয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের সেই রানওয়ের স্মৃতিচিহ্ন। এ দ্বীপেই যৌথ মহড়ায় অংশ নেন দুই দেশের সেনারা।

সম্প্রতি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা এই অঞ্চলে পারস্পরিক পুরোনো দ্বন্দ্ব ও সংঘাত জাগিয়ে তোলা এবং নতুন করে দ্বন্দ্বের ঝুঁকি তৈরি করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়ে যাওয়া উত্তেজনা ও উদ্বেগ থেকে এ অঞ্চল সমরাস্ত্রে নিজেদের শক্তিশালী করার পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

এর পেছনে অবশ্য অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে চীনের সামরিক বিস্তৃতি ও আঞ্চলিক হুমকি, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান ও যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহের বিষয়টি অন্যতম। এ উদ্বেগ থেকেই এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে শুরু করেছে। এ ছাড়া যৌথ প্রশিক্ষণ, অস্ত্র উৎপাদন ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে অবকাঠামো তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে দেশগুলো।

শুধু চীন বদলে যাচ্ছে না, বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যই খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে… এ ধরনের পরিবর্তনের সময় বিশাল ঝুঁকি থাকে

শিবশঙ্কর মেনন, ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা

কয়েক দশক ধরেই বিশ্বের জন্য অর্থনৈতিক ইঞ্জিনে পরিণত হয়েছে এশিয়া। এতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে চীন ও আঞ্চলিক উৎপাদন কেন্দ্রস্থলগুলো। তবে এত দিন এর কেন্দ্রে ছিল কেবল বাণিজ্যের বিষয়টি। কিন্তু এখন দেশগুলোর মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান অস্থির কৌশলগত প্রতিযোগিতা এর অন্যতম কারণ। উদ্বেগের আরেকটি কারণ হচ্ছে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক গত পাঁচ দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মস্কো সফর করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের পর পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। একই সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা কিয়েভ সফর করেছেন। এ থেকে এশিয়ায় মারাত্মক সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট সি তাঁর উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য ‘জাতীয় পুনর্জাগরণ’ সৃষ্টি করা। এর মধ্যে থাকবে এশিয়ায় প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দেওয়া, দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করা ও তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে একীভূত করা। তাইওয়ানকে চীন নিজেদের অংশ হিসেবে দেখে, যদিও তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন হিসেবে মনে করে।
চীনের সামরিক সম্প্রসারণ রুখতে প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র কঠোর শক্তি প্রয়োগের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সেনারা গত অক্টোবরে যৌথ মহড়ায় যোগ দেন। ফিলিপাইনের জামব্যালেস প্রদেশে এই মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ফিলিপাইনও উদ্বিগ্ন
যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সেনারা গত অক্টোবরে যৌথ মহড়ায় যোগ দেন। ফিলিপাইনের জামব্যালেস প্রদেশে এই মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ফিলিপাইনও উদ্বিগ্নছবি : এএফপি

গত ১৩ মার্চ উত্তর কোরিয়া প্রথমবারের মতো সাবমেরিন থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। একই দিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়া ২০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন কেনার পরিকল্পনা সামনে আনে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর সপ্তম দেশ হিসেবে পারমাণবিক সাবমেরিনের মালিক হতে চলেছে অস্ট্রেলিয়া। কয়েক দশকের শান্তিবাদী অবস্থান শেষ জাপানও আক্রমণাত্মক শক্তি হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করছে। জাপান এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে ভারত। দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধবিমান কিনতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। মার্কিন কর্মকর্তারা চীনের আগ্রাসন রুখতে তাইওয়ানে বিশাল অস্ত্র মজুত করার চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে বন্দর ও রানওয়ে সুবিধা বাড়াচ্ছে ফিলিপাইন।

দুই পরাশক্তির সাম্প্রতিক সম্পর্ক

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক মঞ্চে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা স্থল, অর্থনীতি ও সাইবার দুনিয়ায় প্রভাব বাড়াতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনকে রুখতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ বাড়ানো।
টিকটক: ভিডিও শেয়ার করার অ্যাপ টিকটকের মূল কোম্পানি চীনের বাইটড্যান্সকে এই অ্যাপ বিক্রি করে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকির কথা বলে অ্যাপটিকে নিষিদ্ধ করারও হুমকি দিয়েছে ওয়াশিংটন।

গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ‘চীনের নজরদারির’ বেলুনটি ধ্বংস করে যুক্তরাষ্ট্র
গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ‘চীনের নজরদারির’ বেলুনটি ধ্বংস করে যুক্তরাষ্ট্রছবি : রয়টার্স

চীনা নজরদারির বেলুন: কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা নজরদারি বেলুনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সংকট দেখা যায়।
সাবমেরিন চুক্তি: এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সবচেয়ে আগ্রাসী পদক্ষেপ হলো যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে পারমাণবিক সাবমেরিন উন্নয়ন ও মোতায়েনের পরিকল্পনার বিষয়টি।

শিল্প খাতে গোয়েন্দাগিরি

শিল্প খাতে চীনের গোয়েন্দাগিরি বন্ধ করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের অভিযোগ, মার্কিন বাণিজ্য তথ্য ও মেধাস্বত্ব চুরিতে চীন ব্যাপক অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

কিন্তু এসব পদক্ষেপ কি যথেষ্ট? এমন প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। কারণ, চীনের অস্ত্রাগারে এখন বিশাল ‘কোস্টগার্ড কাটার’ বা নৌজাহাজ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক ওয়ারহেডের সরবরাহ দ্রুত বাড়াচ্ছে দেশটি। গত বছরে চীনের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বা বিপজ্জনক আচরণে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ তুলেছে পশ্চিমারা। তাইওয়ানকে হুমকি দিতে রেকর্ডসংখ্যক যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছিল বেইজিং। এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো জাপানের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার জলসীমায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে দেশটি। গত ডিসেম্বরে সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়েছেন চীনের সেনারা।

এসআইপিআরআই বলছে, ২০০০ সালে বিশ্বব্যাপী মোট প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মধ্যে সাড়ে ১৭ শতাংশ ছিল এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের। পরেরর বছর তা বেড়ে হয় ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ (উত্তর কোরিয়া এ হিসাবের বাইরে)

এতে দুই দেশের ২ হাজার ১০০ কিলোমিটার সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। গত মাসে লেজার রশ্মি ব্যবহার করে ফিলিপাইনের এক টহল নৌকার মাঝিকে সাময়িকভাবে অন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি মার্কিন ড্রোনের খুব কাছ দিয়ে উড়ে গিয়ে সেটি ধ্বংস করতে বাধ্য করেছে। এগুলো দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের কর্তৃত্ব দাবির ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

অনেক দেশ মনে করে, এই অঞ্চলে শক্তিশালী সামরিক সমাবেশ চীনকে আরও বেশি দূর এগোতে নিরুৎসাহিত করবে। কিন্তু এ ধরনের সামরিক সমাবেশ যুক্তরাষ্ট্রের আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়ার বার্তা দেবে। এর অন্যতম কারণ ইউক্রেনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে এশিয়ার অনেক দেশের ধারণা জন্মেছে, চীনের অগ্রযাত্রা ঠেকানোর মতো সক্ষমতা মার্কিন সামরিক বাহিনীর কতটা আছে। রাজনৈতিক দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র কতটা কী করতে পারবে, তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।

এশিয়ার বর্তমান নিরাপত্তার দিকটি হিসেবে ধরলে এটি অস্থির এবং অস্থিতিশীল বৈশ্বিক ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়। এর পেছনে রয়েছে এক ব্যক্তির শাসনের দেশ চীনের আরও সামরিক শক্তি বাড়ানোর দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং ধীরগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের মেরুকরণের রাজনীতি, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার শক্তিশালী আগ্রাসন এবং ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর আরও প্রভাব বিস্তারের বাস্তবতা।

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন শিবশঙ্কর মেনন। তিনি বলেন, ‘শুধু চীন বদলে যাচ্ছে না, ক্ষমতার ভারসাম্যই খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, এ ধরনের পরিবর্তনের সময় বিশাল ঝুঁকি থাকে।’